গুয়ান্তামো বে কারাগারের ভ্রাতৃত্ব

গুয়ান্তামো বে কারাগারে ভ্রাতৃত্ব

মনসুর আদায়ফি

ভ্রাতৃত্ব, সহানুভূতি ও দয়াশীলতা, এসব ধর্মীয় মূল্যবোধের ছবক নিয়েই বড় হয়েছি। আর এসবের পূর্ণ অর্থ উপলব্দি ও অনুশীলন হয়েছে গুয়ান্তামো বে কারাগারে। সেখানে আমরা বন্দিরা এমন এক বন্ধন তৈরি করি যা কখনো ভাঙ্গার নয়, এমনকি সবচেয়ে ভয়ঙ্কর নির্যাতন ও নিপীড়নের মধ্যেও নয়। 

গুয়ান্তামো বে কারাগারের ভ্রাতৃত্ব

২০০১ সালের শরতে। আমি তখন আফগানিস্তানে ভ্রমণে ছিলাম। স্থানীয় যুদ্ধবাজরা আমাকে অপহরণ করে এবং মার্কিন বাহিনীর নিকট "জেষ্ঠ্য মিসরীয় আল কায়েদা সদস্য" হিসেবে উপস্থাপন করে তাদের নিকট বিক্রি করে। তখন আমার বয়স ১৮। তার কিছুদিন পর ২০২২ এর ফেব্রুয়ারিতে গুয়ান্তামো বে কারাগারে স্থানান্তর করে।

প্রথম দিকে অনবরত মারধর করা দেখে ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে থাকতাম। তারপর দীর্ঘ ১৪ বছর কারাভোগ। জীবনের এই কঠিনতম সময়ে ছেলে বেলায় পাওয়া নবীর শিক্ষাগুলো ধৈর্য ধারণে সাহায্য করে।

কারাগারের এক ক্যাম্প থেকে অন্য ক্যাম্প, অস্থায়ী সেল থেকে নির্জন কারাবাস ও সেখান থেকে প্রিজন সেল এ স্থানান্তর, সবখানেই আমরা বন্দিরা এক নিবিড় সম্পর্ক গড়ে তুলি, যেখানে জীবন, সংস্কৃতি, ও স্মৃতি অভিন্ন। ভালো অথবা মন্দ, সব সময়ই থেকেছি একটি পরিবার হয়ে। 

২০১০ সালের দিকে আমাদেরকে ক্যাম্প ৬ এ স্থানান্তর করা হয়। সেখানে জিজ্ঞাসাবাদকারী ও কারারক্ষীরা ছিল তুলনামূলকভাবে কম। নিয়ম-কানুনও ছিল অনেকটা শিথিল, যা আমাদের পারস্পরিক সম্পর্ক বৃদ্ধিতে সাহায্য করে। ক্যাম্পের স্টাফদের সঙ্গেও তৈরি হয় সুসম্পর্ক।

একাকী না পড়ে মসজিদের মতই জামায়াতের সঙ্গে নামাজ পড়তাম। ঘরের মত সবাই একসঙ্গে বসে খাবার খেতাম। এবং নিজ কারাকক্ষের প্রতিবেশীদের সঙ্গে কথা বলা, খোশ-গল্পের পাশাপাশি বিভিন্ন ব্লক ঘুরে যতটা সম্ভব সবাইকে সঙ্গ দিতাম। 

আমাদেরতো কিছুই ছিলনা তবু ছিলাম একে অপরের হয়ে। আমরা পরস্পরকে সম্বোধন করতাম "আমাদের আফগান ভাইয়েরা", " আমাদের ইয়েমেনি ভাইয়েরা", ইত্যাদি বলে। একে অপরের সাহচর্যে এসে শিখে নিয়েছি ভিন্ন ভিন্ন প্রথা-সংস্কৃতি। এভাবে আরবরা আফগানদের মত আচরণ করতে শুরু করল এবং আফগানরা আরবদের মত। তবে মার্কিন গোয়েন্দারা এই মেল-বন্ধনকে ভালোভাবে নেয়নি। আমাদের নিজেদের মধ্যে বিবাদ লাগানোর চেষ্টা করেছে। 

একদিন কারা কর্তৃপক্ষ আমাকে একটি আফগান ব্লকে স্থানান্তর করে। তারা ভেবেছিল একজন আরব হয়ে আফগানদের সঙ্গে থাকা আমার জন্য বেশ কষ্টসাধ্য ব্যাপার হবে। অথচ হয়েছে তার উল্টো। তারা আমাকে পরিবারের একজন সদস্যের মতই আপন করে নেয়। আমি সেখানকার নিরক্ষর আফগানদের আরবি শেখাতাম এবং আর তাদের দেশের ভাষা শুনে বুঝতে চেষ্টা করতাম।  

সেখানে একজন আফগান কবি ও গায়ক ছিলেন। কারাগারে বসেই দুইটি কাব্যগ্রন্থ লিখেছেন। ব্লকে হেঁটে হেঁটে সবাইকে, বিশেষ করে আমাকে, কবিতা পাঠ করে শোনাতেন।

ক্যাম্পে বন্দিদের মধ্যে অধিকাংশই ছিল আরব, যারা নির্যাতন ও নিপীড়নের বিরুদ্ধে বিভিন্ন সময়ে প্রতিবাদ করতো। শুরুর দিকে আফগান ও অন্যান্য দেশের অধিকাংশ বন্দিরা এসবে জড়াতো না। প্রশাসন এটাকে ভয়ের আলামত হিসেবে নিয়েছিল এবং আরও বেশি বিভক্তি তৈরির চেষ্টা করতো। 

একদিন একজন পশতু অনুবাদক আফগান বন্দিদের জন্য কয়েকটি শীট নিয়ে আসে, সেখানে আরব বন্দিদের ছবি দিয়ে লেখা "ভণ্ড"। একজন আফগান একটি শীট হাতে নিয়ে তাতে থুতু নিক্ষেপ করে। এটাই ভ্রাতৃত্ব, যার দৃঢ়তা সম্পর্কে মার্কিনিদের ধারণাই ছিল না। তারা ভেবেছিল আমাদেরকে পরিবর্তন করতে পারবে, অথচ পারেনি। 

কাঠিন্যতা, নির্যাতন, ও দুর্ব্যবহার আমাদের পারস্পরিক সম্পর্ককে দুর্বল করতে পারেনি। বরং আমরা গড়ে তুলি অনন্য এক সংহতি।

মার্কিন সেনারা কোনো এক বন্দি ভাইকে নির্যাতন করলে আমাদের অধিকাংশই তাদের সঙ্গে কথা বলা বন্ধ করে দিতাম। এ বন্ধ করে দেওয়াটা কখনই সমন্বিত ছিল না এবং আমরা কাউকে এটা করতে বলতামও না - নির্যাতিত ভাইয়ের পাশে দাঁড়ানোর তাড়ণা থেকেই এমন হয়ে যেতো।

সার্বক্ষণিক উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার মধ্যেও কোনো বন্দির বাড়ি থেকে ভালো খবর আসলে ক্যাম্পে খুশির আবহ সৃষ্টি হতো। কারোর সন্তান বিয়ে করেছে অথবা কেউবা দাদা/নানা হয়েছে। আমরা একসঙ্গে রোজা রাখতাম, এবং উদযাপন করতাম ঈদ-উল-ফিতর ও আজহা উদযাপন করতাম। গুয়ান্তামো থেকে কোনো বন্দিকে অন্যত্র স্থানান্তর করলে আরেকটা আনন্দের পরিবেশ সৃষ্টি হতো। 

কারারক্ষী ও অন্যান্য কর্মকর্তা-কর্মচারিরাদের বলা হয়েছিল তাদেরকে সামলাতে হবে এমনসব দুর্ধর্স খুনি, সন্ত্রাসী ও দানবদেরকে, যারা মুহুর্তেই শরীর থেকে গর্দান আলাদা করে দিতে পারে। পরে আমাদের আচার-আচরণ ও ভ্রাতৃত্ব দেখে তাদের ধারণা পুরো পাল্টে যায়। অনেক বন্দি ও কারারক্ষীদের মধ্যে চমৎকার সম্পর্ক গড়ে উঠে এবং কারারক্ষীদের কেউ কেউ পরবর্তিতে ইসলাম ধর্মও গ্রহণ করে। 

নবীর শিক্ষার যে ক্ষমতা এবং ইসলাম যে বান্দা ও স্রষ্টার (আল্লাহ্‌) মধ্যে নিখুঁত সম্পর্ক এবং আমাদের নিজেদের, পরিবারের, প্রতিবেশীদের, এবং আশপাশের সবার সম্পর্কের উপর প্রতিষ্ঠিত, সহবন্দিদের দৃঢ় বন্ধন ও নৈতিক চরিত্র দেখে তা আবারও উপলব্দ হলো। 

এই সম্পর্কগুলো পরস্পর নির্ভরশীল, এবং এগুলো আমাদেরকে অন্যদের থেকে আলাদা পরিচিতি দান করে। এগুলোই কঠিন বিপদ-মুছিবতে অবিচল থাকতে সাহায্য করে। আমি শিখেছি যখন আমাদের সঙ্গে ঘটতে যাওয়া কোনো কিছু নিয়ন্ত্রণ করতে পারিনা, তখন নিজেদেরকে নিরাপদ রাখতে সামর্থ্যের সবটুকু করে যাওয়া। আমাদের এখনও ক্ষমতা আছে ব্যক্তি হিসেবে নৈতিক গুণে গুণান্বিত হওয়া ও পারস্পরিক সম্পর্ক সদৃঢ় করা। গুয়ান্তামো কারাগারে নবীর এমনসব উপদেশসমূহই আমরা প্রতিদিন অনুশীলন করেছি। 

মনসুর আদায়ফি একজন লেখক, সাহিত্যিক, অধিকারকর্মী ও প্রাক্তন গুয়ান্তামো কারাগারের বন্দি। যিনি কোনো অভিযোগ ছাড়াই ১৪ বছর কারাগারে ছিলেন। তাকে ২০১৬ সালে সার্বিয়াতে মুক্তি দেওয়া হয় যেখানে তিনি একটি নতুন জীবন গঠনে সংগ্রাম করে যাচ্ছেন। তিনি সামাজিক ন্যায় সাংবাদিকতার নন-ফিকশন লেখক শ্রেণীতে ২০১৯ সালে রিচার্ড জে মারগলিস পুরষ্কার পান। তার স্মৃতিগ্রন্থ ডোন্ট ফরগেট, লস্ট এ্যান্ড ফাউন্ড এট গুয়ান্তামো ২০২১ সালের আগস্টে প্রকাশ পায়। 

কাতার ভিত্তিক সংবাদ মাধ্যম আল জাজিরায় ইংরেজিতে প্রকাশিত লেখাটি দ্য ট্রিবিউন এর পাঠকদের জন্য বঙ্গানুবাদ করেছেন করা হলো। 

Post a Comment