ভারতীয় পুলিশের বিরুদ্ধে মুসলিম ও দলিত হত্যার অভিযোগ

তাদেরকে গুলি করো,ভারতীয় পুলিশ,মুসলিম ও দলিত হত্যা,online bangla news bd,online bangla news,online bangla news,daily bangla news
হান্নাহ এলিস-পিটারসন এবং শেখ আজিজুর রহমান, উত্তর প্রদেশ     

উত্তর প্রদেশ পুলিশ বলছে তাদের হেফাজতে থাকাবস্থায় মুসলিম যুবক আলতাফ আত্মহত্যা করেছেন। তবে ঘটনার স্থিরচিত্র প্রকাশ হওয়ার পর অনেকেই এতে সন্দেহ পোষণ করেন। কারণ যে টয়েলেটের পাইপে তিনি নিজেকে ঝুলিয়েছেন বলে পুলিশের পক্ষ থেকে দাবি করা হচ্ছে, মাটি থেকে সেটির উচ্চতা মাত্র ৭৬ সেন্টিমিটার ও সেটি পাতলা প্ল্যাস্টিকের তৈরি। অথচ ২২ বছর বয়সী আলতাফের উচ্চতা ১৬৫ সেন্টিমিটার (৫ ফুট ৫ ইঞ্চি) ও ওজন ৬০ কেজি। ঘটনার দিন থানার সিসিটিভি ক্যামেরা রহস্যজনকভাবে বন্ধ থাকায় এ সন্দেহ আরও ঘনীভূত হয়। 
ভারতীয় পুলিশের বিরুদ্ধে মুসলিম ও দলিত হত্যার অভিযোগ
নিহত ছেলে আলতাফের ছবি হাতে মা ফাতিমা বেগম। ছবি: দ্য গার্ডিয়ান

পরিবার ও বন্ধুরা বলছে ভিন্ন কথা। তারা জানায় কাশগঞ্জের অধিবাসী আলতাফের এক হিন্দু মেয়ের সঙ্গে প্রেমের সম্পর্ক ছিল এবং তিনি তাকে বিয়ের পরিকল্পনা করছিলেন। স্থানীয় ক্ষমতাশালী হিন্দু নজরদারি গোষ্ঠী এই আন্তঃবিয়ের বিরোধিতা করে এবং এ খবরটি পুলিশকে জানিয়ে দেয়। ২০২১ সালের ৯ নভেম্বরে পুলিশ তাকে গ্রেফতার করে এবং হেফাজতে নির্যাতন করে মেরে ফেলে। ঘটনার পর থেকে তাদেরকে চুপ থাকতে হুমকি দেওয়া হচ্ছে বলেও তাঁর পরিবার অভিযোগ করে। 

"পুলিশ আমার ছেলেকে হত্যা করেছে এবং তারপর আমাকে টাকা দিয়ে বলেছে আমি যেন বলি সে বিষণ্ণ ছিল এবং নিজেই নিজের জীবন কেড়ে নিয়েছে," আলতাফের নিরক্ষর বাবা চান মিয়া বলেন। তিনি বলেন, "আমি চুপ থাকবোনা। আমি বিচার চাই।" 

এদিকে গত শুক্রবার তাঁর মৃতদেহটি কবর থেকে উত্তোলন করে ময়নাতদন্ত করার জন্য নির্দেশ দেয় আদালত। 

ভারতের সবচেয়ে জনবহুল রাজ্য উত্তর প্রদেশ। প্রায় ২০ কোটি জনসংখ্যার এই প্রদেশটি বিশ্বের মধ্যে সবচেয়ে জনবহুল উপবিভাগ। এখানে এমন মৃত্যুর শিকার আলতাফই প্রথম নন বরং তাঁর মত আরও অনেকে পুলিশি হেফাজতে মারা গেছেন। 

২০১৮ সাল থেকে এখন পর্যন্ত পুলিশি হেফাজতে ছয়টি মৃত্যুর ঘটনা বিশ্লেষণ করেছে দ্য গার্ডিয়ান। মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথ ও তাঁর ভারতীয় জনতা পার্টির (বিজেপি) শাসনাধীন প্রদেশটির পুলিশের বিরুদ্ধে সবগুলো হত্যাকাণ্ড সঙ্ঘটন ও গোপন করার অভিযোগ রয়েছে। 

উত্তর প্রদেশের মোট জনসংখ্যার প্রায় ২০ শতাংশ মুসলমান। অভিযোগ রয়েছে তাদেরকে নিয়মিতভাবে টার্গেট ও নির্যাতন করছে আদিত্যনাথ সরকার। ভারতের হিন্দু জাতপাত প্রথার সবচেয়ে নিকৃষ্ট হিসেবে বিবেচিত দলিতরাও একই নিপীড়নের শিকার হচ্ছে। রাজ্যটিতে এ দুই সংখ্যালঘু গণপিটুনি, ঘৃণাজনিত বক্তব্য ও পক্ষপাতদুষ্ট বিচারের সম্মুখীন হয়ে আসছে। 

আদিত্যনাথের রাজ্য সরকার আরও পাঁচ বছরের জন্য ক্ষমতায় আসবে কিনা, আসন্ন নির্বাচনে এটি নির্ধারণ হয়ে যাবে। তাই এই নির্বাচনকে দেখা হচ্ছে হিন্দু জাতীয়তাবাদী রাজনীতির উপর একটি গণভোট হিসেবে। যা ভারতকে ধর্মনিরপেক্ষ থেকে হিন্দু রাষ্ট্রে পরিণত করার একটি প্রচেষ্টা। আর এটি ঘটছে দেশটিতে ক্রমবর্ধমান ধর্মীয় অসহিষ্ণুতা ও মুসলিম বিরোধী ঘৃণাজনিত বক্তব্যের পটভূমিতে। 

যোগী আদিত্যনাথ। ছবি: সংগৃহীত

যোগী আদিত্যনাথ। কট্টর হিন্দু সন্ন্যাসী। ২০১৭ সালে ভারতের জাতীয় নির্বাচনে ভারতীয় জনতা পার্টি ক্ষমতায় আসার পর ১৯ মার্চে উত্তর প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে তিনি দায়িত্ব গ্রহণ করেন। তার কিছুদিন পরেই তিনি স্পষ্ট করে দিয়েছেন তাঁর এজেন্ডা হবে দুইটি: হিন্দু জাতীয়তাবাদের উগ্র প্রসার ও অপরাধ দমনে কঠোর ব্যাবস্থা। ২০১৭ সালের জুনে তিনি বলেন, "আগার অপরাধ কারেঙ্গে, তোহ থোক দিয়ে জায়েঙ্গে (যদি কেউ অপরাধ করে, তাকে ধ্বংস করে দেওয়া হবে)।"   

এ বিষয়ে আইনজীবী, অধিকারকর্মী ও প্রাক্তন পুলিশ কর্মকর্তারা অভিযোগ করছেন "থোক দেঙ্গে" - "তাদেরকে গুলি করো" এর অপভাষা - উত্তর প্রদেশে অনানুষ্ঠানিক নীতিতে পরিণত হয়েছে। পুলিশের বিরুদ্ধে অভিযোগ রয়েছে অপরাধী মনে হলেই তারা কারও "তাৎক্ষণিক বিচার" শুরু করে দেয় এবং এসব কাজের জন্য পেশাগতভাবে তাদেরকে পুরুষ্কৃতও করা হয়। 


আইনজীবী এবং ভুক্তভোগীদের পরিবার উত্তর প্রদেশে এক ত্রাসের রাজত্বের বর্ণনা দেন। তারা জানান প্রদেশটিতে মুসলিম ও নিম্ম জাতের লোকদেরকে রাস্তা থেকে তুলে নিয়ে খুন করা হয়। এগুলোকে "বন্দুকযুদ্ধে হত্যা" অথবা তাদের হাতে আটক বন্দিদের নির্মমভাবে হত্যা করে আত্মরক্ষার্থে গুলি বলে দায়মুক্তি পেয়ে যায় পুলিশ। 

যাদের বিরুদ্ধে এসব খুনের অভিযোগ, প্রায় সময় তাদেরকেই তদন্তের দায়িত্ব দেওয়া হয়। ফলস্বরূপ পরবর্তিতে পুলিশি প্রতিবেদন আর জমা দেওয়া হয়না, সাক্ষ্য-প্রমাণ ও সিসিটিভি ফুটেজ গায়েব হয়ে যায়। আদালতে দায়েরকৃত অভিযোগসমূহকে বর্ণনা করা হয় "দুর্ঘটনাজনিত মৃত্যু" হিসেবে এবং একেবারেই হদিস মেলেনা কিছু মামলার।

আজমগড়ে আসন্ন নির্বাচনে প্রার্থী অধিকারকর্মী রাজীব যাদব বলেন, "পুলিশ এখন যোগী সরকারের ভাড়াটিয়া।" 

সরকারি হিসাবে গত পাঁচ বছরে রাজ্যটিতে পুলিশ কর্তৃক ৮ হাজার ৭০০ গুলি নিক্ষেপের ঘটনা ঘটে। দাবি করা হয় এগুলোর মধ্যে ৩ হাজার ঘটনায় পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করলে পুলিশ আসামীদেরকে গুলি করে, বিশেষ করে হাঁটুতে। মানবাধিকার সংগঠনসমূহের মতে এসব কথিত বন্দুকযুদ্ধে কদাচিৎ স্বাক্ষী থাকে। গত পাঁচ বছরে উত্তর প্রদেশে কাউকে মারাত্মকভাবে গুলি করার একজন কর্মকর্তাও শাস্তিমূলক ব্যবস্থার সম্মুখীন হয়নি। 

দুইজন সাবেক পুলিশ কর্মকর্তা দ্য গার্ডিয়ানকে বলেন তাদের অভিজ্ঞতা হল অধিকাংশ তথাকথিত "বন্দুকযুদ্ধে নিহত" ব্যাপারটি পুলিশের মিথ্যাচার। 

আজমগড়ের বাসিন্দা ৪০ বছর বয়সী মুসলিম পানি বিক্রেতা কামরানের বিষয়ে পুলিশ দাবি করে লক্ষ্ণৌয়ে অপরাধ সঙ্ঘটনের সময় তাকা গ্রেফতার করা হয় এবং পরবর্তীতে একটি সন্ত্রাস বিরোধী ইউনিটের সঙ্গে গোলাগুলিতে নিহত হয়।

কিন্তু আইনজীবী আসমা ইজ্জত বলেন পুলিশের একটি ফাঁস হওয়া ছবিসহ সাক্ষ্য-প্রমাণে তাকে পুলিশ হেফাজতে জীবিত অবস্থায় দেখা যায়। ঘটনাটি চাপা দেওয়া হয় ২০২১ সালের নভেম্বরে।  

মৃত কামরানের বাবা নাসিম আহমেদ। ছবি: দ্য গার্ডিয়ান

কামরানের দেহ পরিবারের নিকট হস্তান্তর করা হলে তাতে নির্যাতনের স্পষ্ট চিহ্ন দেখতে পাওয়া যায়। "তাঁর চোখ, ঘাড় ও শরীরে ছিল ক্ষতচিহ্ন এবং পা ও চারটি দাঁত ভাঙ্গা," বলেন তার ৮৭ বছর বয়সী বাবা নাসিম আহমেদ। 

পুলিশ পরে এক প্রতিবেদনে জানায় সে বিভিন্ন মামলায় পলাতক আসামী। তাকে ধরিয়ে দেওয়ার জন্য ২৫ হাজার রুপি পুরষ্কার ঘোষণা করা হয়েছিল। অথচ কামরান তার কাজের অংশ হিসেবে পানি সরবরাহ করতে উক্ত থানায় প্রতিদিনই যেত। এমনকি যেদিন সে খুন হয়, সেদিনও গিয়েছিল।

ভারতে উত্তর প্রদেশেই সবচেয়ে পুলিশ হেফাজতে মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে। সরকারি হিসাবে গত তিন বছরে এরকম মৃত্যু হয়েছে ২৩ টি কিন্তু হেফাজতে মৃত্যুর ঘটনাগুলো ভারতের সর্বোচ্চ আদালতে নিয়ে যাওয়া আইনজীবী মাহমুদ প্রচার মতে প্রকৃত সংখ্যা এর চেয়ে অনেক বেশি।  

"পুলিশ এইসব হেফাজতে মৃত্যু গোপন করে পার পেয়ে যাচ্ছে, এমনকি ভুক্তভোগী পরিবারকেও জানাচ্ছেনা," তিনি বলেন।

শোকসন্তপ্ত পরিবারগুলোকে অনেক ক্ষেত্রে মামলা তুলে নিতে বা চুপ থাকতে পুলিশ চাপ দেয়। ২০২১ সালের মে মাসে পুলিশ হেফাজতে নির্যাতনে মারা যাওয়াদের একজন মুসলিম সবজি বিক্রেতা ফয়সালা হোসাইন (১৮)। মামলাটি বর্তমানে সর্বোচ্চ আদালতে বিচারাধীন। মামলা তুলে হোসাইনের বোন কুশনুমা বানুকে (২৮) ফোনে হুমকি প্রদান ও টাকার প্রস্তাব বিবরণ দ্য গার্ডিয়ান শুনেছে। 

আরও দুইটি পুলিশ হেফাজতে মৃত্যুর ঘটনা দ্য গার্ডিয়ান যাচাই-বাছাই করে দেখেছে ময়নাতদন্তের বিস্তারিত বিবরণ পরিবারগুলোকে জানায়নি পুলিশ। অথচ এটি করতে আইনত পুলিশ বাধ্য।

২০২১ সালের অক্টোবরে পুলিশ হেফাজতে মৃত্যুবরণ করে আগ্রার দলিত অরুন ভাল্মিকি (৩০)। পুলিশের দাবি তিনি হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন। অথচ পরিবারকে জানানো হয়নি ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন। পরিবার দাবি করছে তাকে নির্যাতন করে ও ইলেক্ট্রিক শক দিয়ে মেরে ফেলা হয়। "পুলিশ আমাকে চাপ দিচ্ছে আমি যেন বলি আমার ভাইয়ের হার্টের সমস্যা ছিল কিন্তু এটি সত্য নয় - তিনি সুস্থ-স্বাভাবিক ছিলেন," বলেন তার ভাই সনু নরওয়াল।

উত্তর প্রদেশ সরকার সবগুলো অভিযোগ অস্বীকার করে। "দেশে বিচার ব্যবস্থা আছে এবং বিচারবহির্ভূত হত্যা ঘটেনি। এসব সম্পূর্ণ মিথ্যা এবং এসব ভিত্তিহীন অভিযোগ আমরা মানতে রাজি নই," প্রদেশটির সরকার এক বিবৃতিতে বলে। 

উত্তর প্রদেশে পুলিশের অতিরিক্ত মহাপরিচালক প্রশান্ত কুমার জানান আদালত ও জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের নির্দেশনা ও সব কার্যপ্রণালী কঠোরভাবে অনুসরণ করা হয়।

পুলিশি হেফাজতে মৃত্যুতে "জিরো টলারেন্স" নীতির কথা বলেন কুমার। এতে অপরাধী সাব্যস্ত কর্মকর্তাদের সবসময়ই বরখাস্ত ও জেল-জরিমানা করা হয়, তিনি যোগ করেন। তবে বেশ কয়েকটি পুলিশি মৃত্যুর ঘটনা বিচার-বিশ্লেষণ করে দ্য গার্ডিয়ান দেখতে পায় এক্ষেত্রে জুনিয়র অফিসারকে বরখাস্ত করা হয়েছিল কিন্তু তাদেরকে জেলে যেতে হয়নি। রাস্তায় "বন্দুকযুদ্ধে হত্যা" বা পুলিশি হেফাজতে মৃত্যুর জন্য আদিত্যনাথ সরকারের সময়ে কোনো জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তাকে শাস্তিমূলক ব্যবস্থার মুখোমুখি হতে হয়নি। 

কুমার জানান পুলিশ বাহিনীতে ধর্মীয় বা জাতপাত পক্ষপাতিত্ব নেই এবং নেই ভুক্তভোগীকে চুপ করিয়ে রাখার সংস্কৃতি। "কিভাবে আমরা আমাদের নিজেদের নাগরিকদের মধ্যে বিভেদ তৈরি করতে পারি? এটি সম্ভব নয় এবং ভুলও," তিনি বলেন। "কোন সরকারই আমাদেরকে এমন কিছু করতে বলতে পারেনা, যা ভুল বা অন্যায়।" 

যুক্তরাজ্যের প্রভাবশালী দৈনিক দ্য গার্ডিয়ানে ইংরেজিতে প্রকাশিত আর্টিকেলটি দ্য ট্রিবিউন এর পাঠকদের জন্য ভাবানুবাদ করা হলো। 

1 comment