বৃন্দা কারাত
ভারতের দিল্লীর জাহাঙ্গীরপুরীর একটি মসজিদের সামনে অবস্থিত দোকানপাট বুলডোজার দিয়ে গুঁড়িয়ে বহু মানুষের জীবিকা ধ্বংস করার কাজটি সর্বোচ্চ আদালতের হস্তক্ষেপে সাময়িকভাবে বন্ধ রয়েছে। তারপর আদালতে সলিসিটর জেনারেল এর যুক্তিতর্ক ছিল কেন্দ্রীয় সরকারের মনোভাবেরই বহিঃপ্রকাশ: (১) ১৬ এপ্রিলে সঙ্ঘটিত সাম্প্রদায়িক সংঘর্ষের সাথে উক্ত উচ্ছেদের কোন সম্পর্ক ছিলো না এবং এটি ছিলো অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদের অংশ (২) যেহেতু হিন্দুদের দোকানও ভাঙ্গা হয়েছে, তাই এটি সাম্প্রদায়িক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ছিলো না (৩) অভিযানটি অবৈধও ছিলো না কারণ কিছু দোকানীকে পূর্বেই এ বিষয়ে নোটিশ দেওয়া হয়েছে ও কোন কোন ক্ষেত্রে নোটিশের দরকার পড়েনি।
বিজেপি ও আম আদমি পার্টি উভয় দলের মতে ২০ এপ্রিলে বুলডোজার দিয়ে যাদের দোকান গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়েছে তারা ছিল অবৈধ অভিবাসী, সুতরাং সে অভিযানটি সঠিক পদক্ষেপ ছিল। উভয় দলের এই মিথ্যা বর্ণনার উদ্দেশ্য সেসব গরীব লোকদের উপর অমানবিক আক্রমণকে বৈধতা দেওয়ার চেষ্টা যারা প্রধানত মুসলিম সম্প্রদায়ের। অথচ তারা ভারতের প্রকৃত নাগরিক। আমার প্রশ্ন হল তাদের কথা যদি সত্যও হয়, মানুষের সঙ্গে এভাবে আচরণ করা কি উচিৎ?
দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি হল জাহাঙ্গিরপুরী, ও সি ব্লক কখনোই কোন ধরণের সাম্প্রদায়িক ঘটনা প্রত্যক্ষ করেনি। আমার মনে পড়ে ১৯৭৮ সালের সেপ্টেম্বরে দিল্লীতে ভয়ানক বন্যা হয়। সেসময় জাহাঙ্গিরপুরী ও সি ব্লক ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। সেখানকার শত শত বাসিন্দা - হিন্দু ও মুসলিম উভয়ে - পরস্পরকে সাহায্য করে। বহু বছর ধরে বিভিন্ন সম্প্রদায়ের লোকজন সেখানে শান্তিপূর্ণভাবে বসবাস করে আসছে। হঠাৎ ১৬ এপ্রিলে সেখানে সহিংসতা ছড়িয়ে পড়লো কেন?
ঘটনাটিকে মিডিয়া বিভিন্নভাবে উপস্থাপন করেছে। কিন্তু বিজেপি'র পক্ষ থেকে বলা হয় হনুমান জয়ন্তীতে হিন্দুদের একটি মিছিল সি ব্লক অতিক্রম করার সময় আক্রমণের শিকার হয়। মিছিলে পাথর নিক্ষেপ করা হয়। দিল্লীর মুখ্যমন্ত্রী অরবিন্দ কেজরিওয়াল "পাথর নিক্ষেপকারীদের" সমালোচনা করে বিবৃতি প্রদান করেন।
আরও পড়ুন-
মতামত: ক্যাম্পাসে হিজাব পরা কি আইনশৃঙ্খলার বিষয়?
গুয়ান্তামো বে কারাগারের ভ্রাতৃত্ব
ভাসানচর ও শরণার্থী 'গুদামজাতকরণ'
গুয়ান্তামো কারাগারে জীবন ও মৃত্যু
তারপর দিল্লী পুলিশ ২৭ জনকে গ্রেফতার করে। তাদের দেওয়া প্রথম তালিকায় গ্রেফতারকৃত ১৪ জনের সবাই মুসলিম। এভাবেই সারা ভারতজুড়ে এই ধারণা ছড়িয়ে দেওয়া হয় হিন্দু উৎসব উপলক্ষে একটি মিছিলে মুসলমানরা আক্রমণ করে। অথচ আমরা খোঁজখবর নিয়ে জানতে পারি এটি সম্পূর্ণভাবে একতরফা অভিযোগ ও সত্য আড়ালের চেষ্টা।
সেদিন তিনটি মিছিল হয়েছিলো। এর মধ্যে দুইটির আয়োজন করে বিভিন্ন ব্লকের বাসিন্দারা। আয়োজকরা জানান মার্চেই তারা অনুমতির আবেদন করেন। পুলিশ তাদেরকে নির্দিষ্ট রুটে করার অনুমতি দেয়। তদানুযায়ী তারা মিছিল বের করে ও কোন সমস্যা ছাড়াই বিকাল ৩ টার মধ্যে শেষ করে।
প্রত্যক্ষদর্শীদের মতে তার দুই ঘণ্টা পর ১০০ থেকে ১৫০ যুবক মাইক বাজিয়ে একই এলাকায় মিছিল বের করে। তাদের মধ্যে বেশ কয়েকজনের হাতে ছিলো উন্মুক্ত তলোয়ার ও বড় বড় লাঠি। তাদের মধ্যে অন্তত দুইজনকে পিস্তল উঁচিয়ে ধরতে দেখা যায়। প্রধান সড়ক দিয়ে যাওয়ার পরিবর্তে মিছিলটি সি ব্লকের সরু গলি দিয়ে যায় ও উক্ত মসজিদের বাইরে এসে থামে।
সেখানে তারা আক্রমণাত্মক স্লোগান দেয় ও উচ্চ আওয়াজে গান বাজায়। আর এটি এমন সময়ে করা হয় যখন মুসলমানরা মসজিদটিতে ইফতার ও মাগরিবের নামাজের প্রস্তুতি নিচ্ছিলো। পুলিশ জানায় অনুমতি না নিয়ে অবৈধভাবে মিছিলটি বের করা হয়েছে। প্রশ্ন হল তাহলে অনুমতি দেওয়া হয়েছিলো কেন?
অস্ত্র আইন অনুসারে অনুমতি ছাড়া অস্ত্র বহন নিষিদ্ধ। পুলিশ কেন আইনটির প্রয়োগ করেনি? পুলিশের স্পেশাল কমিশনারের (আইন-শৃঙ্খলা) নিকট আমি এই প্রশ্নটি করলে তিনি জানান মিছিলটি করতে না দিলে সেখানে প্রতিবাদ হতো। এর অর্থ দাঁড়ায় সাম্প্রদায়িক সহিংসতা উস্কে দেওয়ার উদ্দেশ্যেই পুলিশ সশস্ত্র মিছিলটির অনুমতি দেয় এবং পরে পুলিশ তাদেরকেই গ্রেফতার করে যারা এই ষড়যন্ত্রের লক্ষ্যবস্তু ছিলো।
অবৈধ মিছিলটিতে অংশগ্রহণকারীদের এ ধরণের কাজের পরই মসজিদের বাইরে থেকে মিছিলটিতে পাথর নিক্ষেপ করা হয়। একজন মুসলিমকে বন্দুক ব্যবহার করতে দেখা যাওয়ার পরপরই গ্রেফতার করা হয়। অথচ উচিৎ ছিল একই মিছিলে থাকা পিস্তল বহনকারীদেরকেও একই আইনে আটক করা। গ্রেফতারকৃত পাঁচ জন হিন্দুর মধ্যে চার জন একই পরিবারের সদস্য।
পরিবারটির প্রধান সরকারি জমিতে নির্মিত একটি মন্দিরের পুরোহিত। এই পরিবারের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের অভিযোগ আনা হয়েছে। আমাদেরকে কি এটা করতে বিশ্বাস করতে হবে একটি পরিবারের চার জন সদস্যই শুধু অপরাধী? অবৈধ মিছিলটির আয়োজক হিসেবে পুলিশ প্রথমে বিশ্ব হিন্দু পরিষদ ও বজরং দল এর যুব শাখার নাম উল্লেখ করে। পরে এফআইআর থেকে তাদের নাম প্রত্যাহার করা হয়।
নিকটবর্তী এলাকা থেকে বিশ্ব হিন্দু পরিষদের একজন নেতাকে গ্রেফতার করা হলে দলটির জেষ্ঠ্য নেতৃত্ব হুমকি দিয়ে একটি বিবৃতি প্রদান করে। এর কয়েক ঘণ্টার মধ্যে তাকে ছেড়ে দেওয়া হয়। এ সবগুলো ঘটনাই একতরফা ও এর প্রধান উদ্দেশ্য দায়ী হিসেবে মুসলিম সম্প্রদায়কে লক্ষ্যবস্তু বানানো ও তাদের বিরুদ্ধে চক্রান্ত করা।
একবার এই একতরফা বর্ণনা জনসাধারণের মধ্যে বদ্ধমূল হয়ে গেলে পরবর্তী পদক্ষেপ হবে ভয়ভীতি প্রদর্শন, হয়রানি ও "শাস্তিপ্রদান" করা। বিজেপি'র দিল্লী সভাপতি আদেশ গুপ্ত বিজেপি নিয়ন্ত্রিত নর্থ দিল্লী পৌরসভা কর্পোরেশন এর মেয়রের কাছে চিঠি লিখেন। যেখানে তিনি "১৬ এপ্রিলের ঘটনার জন্য দায়ী" "দাঙ্গাকারি ও সমাজবিরোধীদের" অবৈধ স্থাপনায় বুলডোজার পাঠানোর অনুরোধ করেন।
বিজেপি'র অফিশিয়াল টুইটার একাউন্টে ভীতিজনক প্রশ্ন করা হয়, "বুলডোজার কখন পৌঁছাবে?" কেন্দ্রীয় সরকার প্রয়োজনীয় সংখ্যক পুলিশ প্রেরণ করে ও ২০ এপ্রিলে বুলডোজার সি ব্লকে পৌঁছায় এবং প্রধান সড়কের পাশে অবস্থিত স্থাপনাসমূহ বেছে বেছে ভাঙতে শুরু করে। "দাঙ্গাকারীদের শাস্তি দিতে" দিল্লী বিজেপি প্রধান ব্লকটি বেছে নেয়।
প্রকৃতপক্ষে এটি অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ অভিযান ছিলো না। বরং নোটিশ ছাড়া অভিযানটি সম্পূর্ণভাবে অবৈধ ছিল। মসজিদের ১২ টি দোকান গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়। এতে মসজিদটির গেইটও ভেঙ্গে যায়। হিন্দুদের কয়েকটিসহ সংলগ্ন আরও অনেকগুলো দোকান চূর্ণ করে দেওয়া হয়। সেদিন অন্তত ১০০ দরিদ্র দোকানদারের জীবিকা বুলডোজার দিয়ে ধ্বংস করে দেওয়া হয়।
বুলডোজার জাহাঙ্গিরপুরীতে পৌঁছানোর খবর পেয়ে আমি ও আমার সঙ্গীরা সেখানে রওয়ানা করি। এর মধ্যে আমরা জানতে পারি সুপ্রীম কোর্টে আমাদের আপীলটি উল্লেখ করা হয়েছে ও আদালত উচ্ছেদ অভিযানের উপর স্থগিতাদেশ দিয়েছে। সর্বোচ্চ আদালতের আদেশের পরও অভিযান চলতে থাকে।
দুপুরে সেখানে পৌঁছে দেখতে পাই বুলডোজার দিয়ে ভবন ও স্থাপনাসমূহ ভেঙ্গে ফেলা হচ্ছে। নারী ও শিশুরা কাঁদছে। মানুষ নিরুপায় হয়ে দেখছে। এটি ছিলও অতিশয় বেদনাদায়ক। আদালতের আদেশ অমান্য করা উচ্ছেদকারীদের আমরা থামালাম।
জাহাঙ্গিরপুরীর সি ব্লকের বাসিন্দাদের শুধু দোকানপাটই গুঁড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে না, বরং ধ্বংস করে দেওয়া হচ্ছে ভারতের সংবিধান, তাদের আইনি প্রতিকার পাওয়ার, ও সুষ্ঠু তদন্তের অধিকার। বুলডোজার শুধু একটি মেশিন নয়। এটি সাম্প্রদায়িক হিন্দুত্ববাদের বিষাক্ত রাজনীতির বহিঃপ্রকাশ।
এটি প্রকাশ করে সংঘ পরিবারের (রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ বা আরএসএস) রাজনৈতিক কৌশল, যাতে সমর্থন দিচ্ছে বিজেপি নেতৃত্বাধীন কেন্দ্রীয় সরকার, ও প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর বধিরতা।
বৃন্দা কারাত কম্যুনিস্ট পার্টি অব ইন্ডিয়ার (মার্ক্সবাদী) একজন পলিটব্যুরো সদস্য ও প্রাক্তন রাজ্য সভা সদস্য।
এনডিটিভি'র মতামত বিভাগে ইংরেজিতে প্রকাশিত লেখাটি দ্য ট্রিবিউন এর পাঠকদের ভাবানুবাদ করা হয়েছে।